স্বামী বিবেকানন্দ দেশ ও জাতির গৌরব

সোজা কথা সোজা করে বলতে বাঙালি এখন প্রায় ভুলেই গিয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দের সময়ের তুলনায় আমাদের এই চলতি সময়ে কথার ক্ষেত্র আর স্বাধীনতা দুটোই অনেক অনেক বেশি। কিন্তু বাংলার শিরদাঁড়া এই বিপুল মুক্ত ক্ষেত্রেও বুক বেঁধে দাঁড়াতে পারল না। তিনি ছেলেবেলা থেকেই সাহসী ও ধার্মিক ছিলেন। আর ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। বিএ পাশ করার পর তাকে নানা আর্থিক অনটনে ভুগতে হয়। একসময় শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ক্রমে তিনি রামকৃষ্ণদেবের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করেন। দক্ষিণেশ্বরে ঘন ঘন যাতায়াত শুরু হয় তাঁর। অবশেষে তিনি শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন তাঁর।

 

● শিক্ষা:

তিনি আমাদের মাতৃভূমির পুনরুদ্ধারের জন্য শিক্ষার উপর ব্যাপক জোর দেন। তার মতে একটি দেশ সেই অনুপাতে উন্নত হয় কারণ জ্ঞান জনগণের মধ্যে বিতরণ করা হয়। তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি এমন হওয়া উচিত যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের স্বাভাবিক জ্ঞান ও শক্তি প্রদর্শন করতে পারে। তিনি বলেন যে শিক্ষা শিক্ষার্থীদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলবে এবং জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহায়তা করবে।  মানব-সৃষ্টির জন্য একটি চরিত্র গঠনমূলক শিক্ষা প্রচার করেন।  তিনি আধুনিক বিজ্ঞানের পদ্ধতি এবং অনুসন্ধানের সাথে সম্পূর্ণ একমত ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। সর্বদা ভারতীয় জনগণকে জাতিভেদ প্রথা দূর করতে এবং বিজ্ঞান ও শিল্পায়নকে উৎসাহিত করার আহ্বান জানান।  ভারতে বর্ণপ্রথার অনমনীয়তার নিন্দা করেছিলেন তিনি।  ভারতীয় সমাজে বিদ্যমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং বাজে আচার-অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন।

● স্বামী বিবেকানন্দের জাতীয়তাবাদ:

ভারতবর্ষ যখন পরাধীনতার অন্ধকারে নিমজ্জিত, তখন যাঁরা জাতীয়তাবাদের প্রচার করে দেশবাসীকে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি হতদরিদ্র, নির্যাতিত ভারতবাসীকে মানবপ্রেম ও স্বদেশপ্রেমের মন্ত্রে দীক্ষিত করে তাদের নতুন শক্তিতে জাগিয়ে তোলেন। স্বামী বিবেকানন্দ ভারতবাসীকে পরাধীনতার গ্লানি দূর করে আত্মবিশ্বাসী হতে বলেন। তিনি ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থে দেশবাসীকে বলেন, “ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী; বল ভাই— ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ।”

 ● স্বদেশের সংস্কৃতির প্রতি আস্থা: বিবেকানন্দ তাঁর ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের নিন্দা করেন এবং ভারতবাসীকে নিজ সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি আস্থাবান হতে বলেন।

 ● ভারতমাতার বন্দনা: বিবেকানন্দ ভারতবাসীকে বলেন যে, মানুষ জন্ম থেকেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত। এখানে মা বলতে তিনি দেশমাতাকে বুঝিয়েছেন। তিনি ভারতবাসীকে বলেন যে, অন্যান্য দেবদেবী বাদ দিয়ে আগামী ৫০ বছর ভারতমাতাই যেন সবার একমাত্র আরাধ্য দেবী হন। অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাঠী বলেছেন, “যে দেশপ্রেম বঙ্কিমচন্দ্রে ছিল কবিকল্পনা, বিবেকানন্দের রচনায় তা একটি অবয়ব নিল।”


সন্ন্যাসগ্রহণের পর তাঁর নাম হয় স্বামী বিবেকানন্দ এবং শ্রীরামকৃষ্ণদেবের তিরোধানের পর তিনি পরিব্রাজক হয়ে সারা ভারত ভ্রমণ করেন। এবার তিনি শুরু করলেন মানব সেবার কাজ। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে শিকাগো শহরের ধর্ম মহাসভায় যোগ দেবার জন্যে তিনি আমেরিকায় যান। ওই সভায় তাঁর বক্তৃতা শুনে উপস্থিত সকলেই মুগ্ধ হন। সারা পৃথিবীতে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। বহু বিদেশি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। দেশে ফিরে এসে তিনি গড়ে তোলেন রামকৃষ্ণ মিশন। প্রতিষ্ঠা করেন বেলুড় মঠ। অনেকগুলি গ্রন্থও রচনা করেন। বিবেকানন্দ ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো শহরে আয়োজিত বিশ্বধর্ম সম্মেলনে উপস্থিত থেকে সেখানে ভারতের অদ্বৈত বেদান্তের কথা বিশ্ববাসীকে শোনান এবং বিশ্ববাসী ভারতের উদার ধর্মীয় ঐতিহ্যের কথা শুনে মুগ্ধ হয়। এতে ভারতীয় ঐতিহ্যের মর্যাদা বাড়ে।

Comments.

Leave a Comment.

Share this pen