বাংলার কুটির শিল্প:
পশ্চিম বঙ্গের কুটির শিল্প আজ রাজ্য, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের বাজারে সমাদৃত। বর্তমানে, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার কুটির শিল্পের কারিগররা তাদের নিজ হাতে তৈরি পণ্য প্রদর্শন করছেন বিশ্বের বিভিন্ন হস্তশিল্প উৎসবে। মুখ্যমন্ত্রীর ‘বিশ্ববঙ্গ’ পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গের কুটিরশিল্পকে বিশ্ব বাজারে পৌঁছে দেওয়া। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রাজ্যের কুটিরশিল্পের কারিগররা এ প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে চলেছেন। সরকারের তরফে এই প্রকল্প পেয়ে গ্রামের শিল্পীরা বেশ খুশি।
পটচিত্র, ছৌ, মৃৎশিল্প, ডোকরা, মাদুরের মতো হরেক রকমের জনপ্রিয় হস্তশিল্পের সম্ভার দেখাযাচ্ছে বিশ্ব বাজারে। ইউরোপ সহ আরব এমনকি আফ্রিকার বাজারে বাংলার মানুষের হস্তশিল্পকে পৌঁছে দিতে নানান প্রদর্শনীকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
বাংলার কুটিরশিল্পের ঐতিহ্য: বাংলার কুটিরশিল্পের ছিল অতীত ঐতিহ্য । ঢাকাই মসলিন ছিল জগদ্বিখ্যাত। এ ছাড়াও যশোরের বোতাম ও চিরুনিশিল্প, ঢাকার অত্যাশ্চর্য শঙ্খ-শিল্প বিশ্বব্যাপী বিস্ময় সৃষ্টি করত। বাংলার মিষ্টান্নশিল্প, মাদুরশিল্প, সূচিশিল্প, চর্মশিল্প, হস্তনির্মিত কাগজ, সাবান, ঝিনুক, বাঁশ ও বেতের নানারকম জিনিস, কাচের চুড়ি, কার্পেট ইত্যাদি শিল্পেরও কদর ছিল ব্যাপক। কুটির শিল্পীরা বংশপরম্পরায় একই ধরনের শিল্পের চর্চা করত।
তাঁত শিল্প: পশ্চিমবঙ্গের একটি উল্লেখযোগ্য ক্ষুদ্র শিল্প হল তাঁত শিল্প। নদিয়ার শান্তিপুর, ফুলিয়া, বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর, হুগলি জেলার ধনেখালি তাঁত শিল্পের জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও হুগলীর চন্দননগর তাঁতের গামছা তৈরীর শিল্পের জন্য অতীতে অত্যন্ত বিখ্যাত ছিল।
মৃৎ শিল্প: কলকাতার কুমোরটুলি মাটির মূর্তি নির্মাণের জন্য, নদিয়ার কৃষ্ণনগর, হুগলীর চন্দননগর ঠাকুর এবং মাটির পুতুল তৈরির জন্য ও বাঁকুড়ার পোড়ামাটির কাজ (টেরাকোটা) বিখ্যাত। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গোর অধিকাংশ জেলাতেই মৃৎশিল্পীরা (কুমোর) মাটির হাঁড়ি, কলসি, ভাঁড় প্রভৃতি তৈরি করে থাকেন।
রেশম শিল্প: মুরশিদাবাদ, মালদহ, বীরভূম, বাঁকুড়া জেলার একটি উল্লেখযোগ্য শিল্প হল রেশম শিল্প। এই সমস্ত জেলায় তুঁত, পলাশ প্রভৃতি গাছে রেশমকীট পালন করা হয়, যা থেকে এই শিল্পের কাঁচামাল রেশম পাওয়া যায়। মুরশিদাবাদ জেলা থেকে বালুচরি সিল্ক শাড়ির উদ্ভব।
বাঁশ ও বেত শিল্প: পশ্চিমবঙ্গের এটি একটি প্রাচীন কুটির শিল্প। চেয়ার, টেবিল প্রভৃতি দৈনন্দিন ব্যবহার্য নানা জিনিস এই শিল্পে প্রস্তুত করা হয়। দার্জিলিং, কালিম্পং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার জেলার বহু মানুষ এই শিল্পকর্মের সঙ্গে যুক্ত। দার্জিলিং-এর বেতের কাজ আজও বিশ্ববাজারে সমাদৃত।
খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প : জ্যাম, জেলি, ভোজ্য তেল, দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ, মিনারেল ওয়াটার প্রস্তুত প্রভৃতি শিল্পে মালদহ, মুরশিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুরের বহু মানুষ যুক্ত রয়েছে।
লৌহজাত দ্রব্য: পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় লোহা থেকে কাস্তে, কোদাল, নিড়ানি, ছুরি, কাঁচি, দা, শাবল ইত্যাদি তৈরির কাজে বহু মানুষ (কামার) নিযুক্ত রয়েছে।
অন্যান্য শিল্প : অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মধ্যে ঝিনুক ও শঙ্খের কাজ (পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর), বাদ্যযন্ত্র নির্মাণ, খেলার সামগ্রী নির্মাণ, খেজুর, তাল, আখের রস থেকে গুড় তৈরি শিল্প, ডোকরাশিল্প (বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর), মাদুর শিল্প (পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর), শীতলপাটি (কোচবিহার), ছৌনাচের মুখোশ তৈরি (পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডি), স্বর্ণ শিল্প (কলকাতার বৌবাজার) বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
কুটিরশিল্পের অবনতির কারণ: কুটিরশিল্পের সেই গৌরবময় সূর্য আজ অস্তমিত। কুটিরশিল্প আজ যন্ত্রশিল্পের কাছে হার মানতে বাধ্য হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের রুচির পরিবর্তনে দেশীয় কুটিরশিল্পজাত দ্রব্যগুলো গুণে শ্রেষ্ঠ হলেও আমরা কলে প্রস্তুত দ্রব্যসমূহের বাহ্য ঔজ্জ্বল্য ও সূক্ষ্ম কারুকার্যে মুগ্ধ হয়ে সেগুলো ক্রয় করি। তৃতীয়ত, দেশি শিল্পের উন্নতি বিধান করতে হলে যে পরিমাণ স্বদেশপ্রেম ও ত্যাগ স্বীকার প্রয়োজন, আমাদের মধ্যে তার অভাব রয়েছে প্রচুর। আমাদের স্বার্থপরতার ফলে দেশি কুটিরশিল্পগুলোর চরম অবনতি ঘটেছে।
কুটিরশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার উপায়: আমাদের মতো দরিদ্র দেশের আর্থিক অবস্থার উন্নতি বিধান করতে হলে কুটিরশিল্পের উদ্ধার ও উন্নয়নের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। কুটিরশিল্পজাত দ্রব্যাদি বিক্রয়ের জন্যে সরকারি উদ্যোগ একান্ত কাম্য। দেশের নারীসমাজের বৃহৎ অংশকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে কুটিরশিল্পে নিয়োজিত করতে হবে। দেশের বাইরে শিল্পজাত দ্রব্যাদির বাজার সৃষ্টিতে সচেষ্ট হতে হবে। নতুন নতুন কুটিরশিল্প উৎপাদনে সহযোগিতা করার ও পরামর্শ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের সাহায্য ও সহযোগিতা একান্তভাবে কাম্য।
Comments.