কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ  যখন মধ্য গগনে তখন শরৎচন্দ্রের দিব্য জ্যোতি  ছড়িয়ে পড়েছিল তাদেরই উদ্দেশ্যে "সংসারে যারা শুধু দিলো, পেল না কিছুই। তাই বাংলা কথাসাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের পর যে নামটি স্বাভাবিকভাবে মনে উঁকি দেয়; তিনি আর কেউ নন ~অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পাঠকের হৃদয়ে ই লেখকের যথার্থ প্রতিষ্ঠা। শরৎচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সেই অক্ষয় প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। কথাসাহিত্যের অমরস্রষ্টা ,অপরাজেয় জীবন-শিল্পী শরৎচন্দ্র আমাদের হৃদয় আসনে চির- আসীন।

বেড়ে ওঠা ও শিক্ষা জীবন:
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই সেপ্টেম্বর হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী।  পাঁচ ভাই এবং  বোনের মধ্যে শরৎচন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান।  শরৎচন্দ্র সাহিত্যসাধনার প্রেরণা লাভ করেন শৈশবকালে পিতার কাছ থেকে।

তার পিতা মতিলাল চট্টোপাধ্যায় অনিয়মিত চাকরির কারনে পরিবার দারিদ্র্যে ছিল। তিনি এমন একজন লেখক ছিলেন যিনি স্বপ্ন দেখে, অলস হয়ে পড়েছিলেন এবং কখনও কোনও কাজ শেষ করেন না। ১৮৯৫ সালে শরৎচন্দ্রের মা মারা যান। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার পিতামাতার পাঁচ সন্তানের একজন ছিলেন। তার মায়ের মৃত্যুর পরে, পরিবারের বিভিন্ন সময়ে অন্য সদস্যরা সমর্থন করেছিলেন।

তার পড়াশুনা দেবানন্দপুরের প্যারী পণ্ডিতের পাঠশালায় থেকে শুরু হয়েছিল। তিনি হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলে যোগদান করেন। তিনি ভাল ছাত্র ছিলেন তিনি সাহসী এবং সাহসীও ছিলেন। তবে দারিদ্রতার কারণে তাকে স্কুল ছেড়ে দিতে হয়। দারিদ্র্যের কারণে মতিলাল স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ভাগলপুরে থাকতেন তাই ভাগলপুরে মামার বাড়িতে থাকাকালীন তিনি প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করেছিলেন। তার পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলে তিনি নাটক এবং খেলাধূলা, অভিনয় করতে নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন।

কর্মজীবন:

অধ্যয়নে বিরতি ঘটার পর শরৎচন্দ্র বনেলি স্টেটে সেটেলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এর পর তিনি কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক এবং বার্মা রেলওয়ের হিসাব দফতরের কেরানি পদে চাকরি করেন। এক সময় তিনি সন্ন্যাসী দলে যোগ দেন এবং গান ও নাটকে অভিনয় করেন। শরৎচন্দ্র কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি কয়েক বছর বাদে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন এবং হাওড়া জেলা জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন।

অমর সৃষ্টি:
তাঁর প্রথম উপন্যাস 'বড়দিদি' ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যজগতে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এর পর তিনি একে একে 'বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য', 'পরিণীতা', 'বৈকুণ্ঠের উইল', 'পল্লীসমাজ', 'দেবদাস', 'চরিত্রহীন', 'নিষ্কৃতি', 'শ্রীকান্ত', 'দত্তা', 'গৃহদাহ', ‘দেনাপাওনা’, ‘পথের দাবী’, ‘শেষ প্রশ্ন’ ইত্যাদি গল্প উপন্যাস এবং ‘নারীর মূল্য’, ‘স্বদেশ ও সাহিত্য’ প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলির মধ্যে 'শ্রীকান্ত', 'চরিত্রহীন' 'গৃহদাহ', ‘দেনাপাওনা’, ‘পথের দাবী’ খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর 'পথের দাবী' উপন্যাসটি বিপ্লববাদীদের প্রতি সমর্থনের অভিযোগে ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে।

শরৎচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের এক জন অমর কাব্যশিল্পী। তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয় পল্লীর জীবন ও সমাজ। ব্যক্তিমানুষের মন পল্লীর সংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতার আঘাতে কতটা রক্তাক্ত হতে পারে তারই রূপচিত্র এঁকেছেন তিনি তাঁর রচনায়। তবে তাঁর উপন্যাসে ব্যক্তিবর্গের ইচ্ছাভিসার ও মুক্তি সর্বদাই সমাজ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয় বলে তাঁকে রক্ষণশীলও বলা হয়ে থাকে। তবে নারীর প্রতি সামাজিক নির্যাতন ও তার সংস্কারবন্দি জীবনের রূপায়ণে তিনি বিপ্লবী লেখক বিশেষত গ্রামের অবহেলিত ও বঞ্চিত নারীর প্রতি তাঁর গভীর মমত্ববোধ ও শ্রদ্ধা তুলনাহীন। সামাজিক বৈষম্য, কুসংস্কার ও শাস্ত্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। কাহিনী নির্মাণে অসামান্য কুশলতা এবং অতি প্রাঞ্জল ও সাবলীল ভাষা তাঁর কাব্যসাহিত্যের জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির প্রধান কারণ। বাংলাসহ ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় তাঁর অনেক উপন্যাসের চিত্রনাট্য নির্মিত হয়েছে এবং সেগুলি অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে যা 'দেবদাস', 'শ্রীকান্ত', 'রামের সুমতি', ‘দেনাপাওনা’, ‘বিরাজবৌ’ ইত্যাদি।


পুরস্কার ও সম্মাননা:
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয়তার দরুন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী’ নামে খ্যাত। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক পুরস্কার পান। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্য হন। এছাড়াও তিনি ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডিলিট’ উপাধি পান।

জীবনাবসান:
রেঙ্গুন থেকে বাংলায় ফিরে আসার পর তার শারীরিক অবস্থা খুব একটা আশানুরূপ ছিল না। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে শরৎচন্দ্র মহাশয়ের শারীরিক অবস্থা সঙ্কটজনক পরিস্থিতি পৌঁছালে চিকিৎসকের পরামর্শে তিন-চার মাস দেওঘরে কাটিয়ে কলকাতায় ফিরে আসলে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই সময় তার যকৃতে ক্যান্সার ধরা পড়ে, পরে তা পাকস্থলী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লে। বিধানচন্দ্র রায় ও কুমুদশঙ্কর প্রমুখ অস্ত্রোপ্রচারের পক্ষে মত দিলে, ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ১২ই জানুয়ারী শল্য চিকিৎসক ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় তার দেহে অস্ত্রপ্রচার করলে শারীরিক অবস্থা দিন দিন আশঙ্কাজনক হয়ে পড়ে চার দিন অর্থাৎ ১৬ই জানুয়ারি সকাল দশটা নাগাদ পরলোক গমন করেন।

Comments.

Leave a Comment.

Share this pen